মাটির সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে জৈব সার হিসাবে জমিতে ভার্মি কম্পোষ্ট ব্যবহার করুন

জৈবসার হিসাবে জমিতে ভার্মি কম্পোষ্ট ব্যবহার করুন, মাটির সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনুন

ফসলের অধিক উৎপাদনের জন্য আদর্শ মাটির দরকার। তাই জমিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা চাই। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে মাটিতে জৈব অংশ ৩ ভাগের নিচে সেগুলো সুস্বাস্থ্যের অন্তর্ভূক্ত নয়। অথচ আমাদের অধকিাংশ জমিতে এর উপস্থিতি এক থেকে দেড় ভাগ। কোথাও এক ভাগের নিচে নেমে এসেছে।


মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকার কারনগুলো হলোঃ-

  •  ফসল আবাদে জৈবসার ব্যবহার না করা।
  • অতিরিক্ত রাসায়নকি সার প্রয়োগ।
  • একই জমিতে এক ধরনের ফসল চাষ।
  • জমিকে বিশ্রাম না দেওয়া।
  • জলবায়ু পরিবর্তন।
  • বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি।

এভাবে চলতে থাকলে এক সময় মাটি র্উবতা হারাবে। খাদ্য নিরাপত্তায় আসবে বড় ধরনের হুমকি। এ থেকে পরিত্রানের জন্য জমিতে পরিমাণমত জৈব পর্দাথ সরবরাহ অত্যাবশ্যক। 

আরও

জৈব পর্দাথের উপকারিতার মধ্যে রয়েছেঃ-

  • রাসায়নকি সারের কার্যকারিতা বাড়ায়। একই সাথে প্রয়োজনীয়তাও কমায়।
  •  বেলে মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আবার এলেট মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা ভারসাম্য রাখে।
  • অনুজীবের ক্রিয়া বাড়ায়।
  • মাটিকে ঝুরঝুরে রাখে।
  • মাটির স্বাস্থ্যকে অনুকূল রাখে ।

অত্যান্ত সহজলভ্য ও সস্তা এই জৈব পদার্থের উৎস হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জৈব সার। এর মধ্যে কেঁচোসার বা ভার্মি কম্পোস্ট বর্তমানে কৃষকের কাছে বেশ জনপ্রিয় । এটি উচ্চ মানসম্পন্ন। অন্য সারের তুলনায় পুষ্টি উপাদান এবং জনপ্রিয়তার পরিমান উভয়ই বেশি থাকে। উদ্ভিদ এবং প্রাণিজ বর্জ্যকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের কেঁচোর সাহায্যে এই সার তৈরি করা হয়।

আরও

পুষ্টিমান

উদ্ভিদের পুষ্টিমান বিবেচনায় ভার্মি কম্পোস্ট এক অনন্য জৈবসার। অন্য জৈবসারের তুলনায় এর পুষ্টিমান শতকরা প্রায় ১০ ভাগ বেশি। এতে জৈব পদার্থ থাকে শতকরা ২৮.৩২ ভাগ, নাইট্রোজেন ১.৫৭ ভাগ, ফসফরাস ১.২৬ ভাগ, পটাশিয়াম ২.৬০ ভাগ , ম্যাগনেসিয়াম ০.৬৬ ভাগ সালফার ০.৭৪ ভাগ, ক্যালসিয়াম ২ ভাগ, বোরন ০.০৬ ভাগ, ম্যাঙ্গানিজ ৭১২ পিপিএম, জিষ্ক ৪০০ পিপিএম, কপার ২০ পিপিএম এবং আয়রন আছে ৯৭৫ পিপিএম।

আরও

 

উপকরণ

গরুর গোবর কেঁচোসার তৈরির উৎকৃষ্ট উপকরণ। অন্য উপকরণের মধ্যে রয়েছে মহিষ , ছাগল এবং ভেড়ার মল। হাঁস-মুরগির বিষ্ঠাও ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই গোবর, মাটি কিংবা খড়ের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে, নয়তো কেঁচোর ক্ষতি হতে পারে। ফসলের উচ্ছিষ্টাংশ যেমন: ফল ও সবজির খোসা , ধান এবং গমের খড়, লতাপাতা, আখের ছোবড়া, ধানের তুষ, মুগের খোঁসা, মাসকলাইয়ের খোসা, খেসারির খোসা, গমের ভুসি এসব ও ব্যবহারযোগ্য। এর পাশাপাশি কচুরিপানা, আগাছা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বর্জ্য এবং বায়োগ্যাস প্লান্টের উচ্ছিষ্টাংশ ব্যবহার করা যায়। এছাড়া নির্দিষ্ট প্রজাতির কেঁচো, পাত্র হিসেবে মাটি কিংবা সিমেন্টের তৈরি চাড়ি অথবা রিং কিংবা কাঠের বাক্স বা ইটের তৈরি চৌবাচ্চা, চটের বস্তা, চালুনি প্রয়োজন হবে।

আরও

কেঁচোর বৈশিষ্ট্য

পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির কেঁচো দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশেই রয়েছে অর্ধসহস্রাধিক । যদিও দেশীয় কেঁচো সার তৈরিতে ব্যবহার উপযোগী নয়। এ জন্য দরকার উন্নত কেঁচোর জাত সংগ্রহ। এর মধ্যে ইউড্রিলাস ইউজেনি, আইসেনিয়া ফিটিডা, পেরিওনিক্স এবং ফেরেটিমা এই ৪ ধরনের কেঁচো এদেশে ব্যবহার হচ্ছে। এরা রাক্ষুসে স্বভাবের হয়। প্রায় সব ধরনের খাবার প্রচুর পরিমান গ্রহণ করে। শীত প্রজাতির সাথে বসবাসে সমস্যা হয় না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কম। এ ধরনের কেঁচোর সংখ্যা প্রতি ৩ মাসে দ্বিগুণ হয়ে যায়। চাষের শুরুতে এসব কেঁচো অস্ট্রোলিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম এবং ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল। এখন আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। প্রতি হাজার কেঁচোর ওজন প্রায় ১ কেজি। এরা দিনে ৫ কেজি পরিমান সবুজসার খেতে পারে। ১ কেজি কাঁচা গোবর হতে প্রায় ৫০০ গ্রাম কম্পোস্ট উৎপাদন করতে পারে। এরা উৎপাদনকালীন সময়ে (২ মাস) ১০ কেজি সার তৈরি করতে সক্ষম।

আরও

সার প্রস্তুতকরণ

কেঁচো কম্পোস্টের জন্য সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না, স্বাভাবিক বাতাস চলাচল করে এবং বন্যার পানি প্লাবিত হওয়ার আশষ্কা নেই এমন উঁচুস্থানকে বেছে নিতে হবে। রোদ-বৃষ্টি  প্রতিরোধে উপরে ছাউনির ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কেঁচো রাখার পাত্রের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ যে কোনো আকারের হতে পারে। তবে উচ্চতা হবে ১-১৫ ফুট। এর বেশি নয়। পাত্রে অতিরিক্ত পানি যেন জমতে না পারে সেজন্য এর তলদেশে ছিদ্র রাখতে হবে। পাত্রের তলদেশে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ ইটের ধোয়া কিংবা  পাথরের কুচি ব্যবহার করতে হবে। এর উপরে ১ ইঞ্চি পুরু করে বালির আস্তরন রাখা চাই। রিং ব্যবহার গর্তের নিচে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তা না হলে কেঁচো গর্ত থেকে বের হয়ে যেতে পারে। ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির জন্য ৬ ইঞ্চি পুরু করে একটি বেড তৈরি করা দরকার । আর তা মাটি এবং গোবরের সমানুপাতের মিশ্রণ হতে হবে। এর উপরে কেঁচো ছেড়ে দিতে হবে। ২ মিটার লম্বা এবং ১ মিটার চওড়া গর্তে সাধারণ ৫০০ কেঁচো ছেড়ে দিলেই চলবে।

আরও

এরপর ইঞ্চি পরিমাণ জৈবপদার্থ এবং ইঞ্চি কাঁচা পাতা দিতে হবে খাবারের জলীয় অংশ কম থাকলে প্রয়োজনীয় পানি ছিটানো দরকার খাবাবের শতকরা ৫০-৬০ ভাগ পানি থাকা উত্তম কেঁচোর খাবারের জন্য ভাগ কাঁচা গোবর, ১২ ভাগ জৈব আবর্জনা, ভাগ মাটি এবং ভাগ খামারজাত সার একত্রে মিশিয়ে ১৫ দিন স্তূপাকারে রেখে দিতে হয় আধা পচা এই খাবার নির্দিষ্ট সময় পরপর পাত্রে প্রয়োগ করতে হবে এক্ষেত্রে প্রথমবার দেওয়া মাস পর দ্বিতীয়বার খাবার দিতে হয় এরপর প্রতি   দিন অন্তর দিতে হবে খাদ্য হিসেবে গাছের কচি পাতাও ব্যবহার করা যেতে পারে খাবার দেয়ার পর পাত্রের উপর পাটের চট ভিজিয়ে ঢেকে রাখতে হবে  নারিকেল বা কলাপাতা দিলেও চলবে প্রথমবার সার প্রস্তুত হতে সময় লাগে মাস তবে পরবর্তীতে ৪০ দিনের বেশি প্রয়োজন হবে না কেননা তখন কেঁচো এবং ব্যাক্টোরিয়ার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে প্রস্তুতকৃত সার চায়ের দানার মতো মনে হবে উপরের স্তরে কালচে বাদমি রঙ ধারণ করবে দুর্গন্ধ থাকবে না সামান্য ঝুরঝুরে হবে সার তৈরি হয়ে গেলে কেঁচোগুলো আলাদা করার জন্য / দিন পূর্বে পানি দেয়া বন্ধ রাখতে হবে এতে শতকরা ৮০ ভাগ কেঁচো নিচে চলে যাবে তখন চালুনি দিয়ে কেঁচো আলাদা করতে সহজ হবে এজন্য এমন চালুনি ব্যবহার করতে হয়, যার ছিদ্র . মিলিমিটারের বেশি নয় এছাড়া কেঁচো মিশ্রিত সার আলোকিত স্থানে রেখে কিছুক্ষন অপেক্ষা করলে কেঁচোগুলো আলো এড়ানোর জন্য নিচে চলে যাবে তখন উপর থেকে সার তুলে এনে আবার একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এভাবে একসময় সার আর কেঁচো আলাদা করা যাবে

আরও


সার সংরক্ষণ

সদ্য প্রস্তুতকৃত সারে সাধারণত (২৫-৩০)% আর্দতা থাকে যা সংরক্ষণযোগ্য নয়। তাই রোদে শুকিয়ে এর পরিমান ১২-১৫ ভাগের মধ্যে দিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তখন ৬-৭ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। এজন্য বায়ু চলচল করতে পারে এমন পাত্র কিংবা চটের বস্তা ব্যবহার করা যেতে পারে। উন্নত ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করলে সারের গুণাগুণ ৩ বছর পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে।

আরও

সতকর্তা

হাঁস-মুরগি, অন্যান্য পাখি, উইপোকা, তেলাপোকা, গুবরেপোকা, পিঁপড়া এবং ইঁদুরজাতীয় প্রাণী কেঁচো খেতে  পছন্দ করে। তাই এদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হাউজের চারপাশে কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। ভেতরে নয়। এছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম করে মরিচ ও হলুদের গুঁড়া এবং অল্প পরিমান লবণ মিশিয়ে পিটের বাহিরের চারদিকে ছিটিয়ে দিলেও হবে। পাখির আক্রমন থেকে রেহাই পেতে হাউজের উপর ঢাকনা কিংবা নেটের ব্যবস্থা রাখা চাই। কেঁচোকে সক্রিয় রাখতে যেমন বেশি পানি দেয়া যাবে না, তেমনি শুকিয়ে ফেলাও ঠিক হবে না। পাত্রের উচ্চতা যেন আড়াই ফুটের অধিক না হয়। কেননা গভীরতা বেশি হলে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিবে। তখন কেঁচো পাত্রের তলদেশে যেতে চাইবে না। এছাড়াও খাবার গ্রহনে অনীহা সৃষ্টি হবে। নির্দিষ্ট জাত ব্যতীত অন্য কেঁচো থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত গোবরের সাথে বালি, পাথর, ইটের টুকরা, কাঁচভাঙ্গা, ছাই, পলিথিন থাকা চলবে না। কেঁচোর খাবার হিসেবে শুকনো পাতা, মরিচ, পেঁয়াজের খোসা, অন্যান্য মসলা এবং কাঁচা কিংবা রান্না করা মাছ মাংসের উচ্ছিষ্টাংশ, লেবু, তেঁতুল, টমেটো এমন অম্ল সৃষ্টিকারী বর্জ্য ব্যবহার করা যাবে না।

আরও

সার ব্যবহারের মাত্রা

ভার্মিকম্পোস্ট ফসল চাষের যে কোনো পর্যায়ে প্রয়োগ করা যায়। তবে শস্য ভেদে ব্যবহার মাত্রার ভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে আলু, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, হলুদ এবং ধানের ক্ষেত্রে অনুমোদিত রাসায়নিক সারের অর্ধেকের সাথে একর প্রতি ১ টন দিলেই হবে। তবে বেগুন, শশা, মিষ্টিআলু, গাজর, ঢেঁড়শ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা এসব ফসলের বেলায় হেক্টর প্রতি ১০০০ কেজি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। সরিষা, তিল, মাসকলাই, ছোলা এ জাতীয় ফসলের রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করেই একর প্রতি ২৫০-৩০০ কেজি কেঁচোসার ব্যবহার করলেই হবে। পেয়ারা, কলা, পেঁপে, ডালিম, লেবু এসব ছোট গাছের ক্ষেত্রে রোপণের সময় এবং ফুল আসার পূর্বে গাছ প্রতি ৫ কেজি হারে আর আম, কাঠাল, নারিকেলের ক্ষেত্রে ৮-১০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিছু পরিমাণ সার বাড়িয়ে দিলে ভালো হবে।

জমিতে কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করলে কোনো কোনো ফসলের জন্য রাসায়নিক সারের পরিমান কম লাগে। কোনো কোনো ফসলের প্রয়োজনই হয় না। খরচ পড়ে কম। উৎপাদিত ফসলের স্বাদ, রঙ এবং গন্ধ অতুলনীয় হয়। বীজের অষ্কুরোদগম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মাটির বুনট হয় উন্নত। ফলে শস্যদানা গঠন, ছড়া ও কুশি হয় আশানুরূপ। ফল ও কান্ডজাতীয় ফসলের মান হয় গুণগত। পাশাপাশি রোগবালাইয়ের আক্রমণ হ্রাস পায়, পরিবেশকে রাখে অনুকূলে। তাইতো এই সার ফসলের জন্য এক অনন্য আর্শীবাদ।

আরও


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)